শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ || ৬ পৌষ ১৪৩১

দৈনিক গাইবান্ধা

প্রকাশিত : ১৬:১৪, ১৪ মে ২০২৪

কচি কলাপাতায় বাঁধা মহিষের দুধের দই

কচি কলাপাতায় বাঁধা মহিষের দুধের দই
সংগৃহীত

দইভরা ছোট মাটির পাত্রের মুখটা থাকে কচি কলাপাতায় বাঁধা। খুলতেই চোখে পড়বে ধবধবে সাদা দই। মিহি ঘ্রাণ ছড়ানো সেই দইয়ের স্বাদ হয় মনভোলানো। মেজবান কিংবা অতিথি আপ্যায়নে মিরসরাইয়ের মানুষের চিরায়ত এক খাবার অনুষঙ্গ এই মহিষের দই। গুণে-মানে অতুলনীয় মিরসরাইয়ের এ দই স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছে অন্তত পাঁচ দশক ধরে।

মিরসরাইয়ে মহিষের দই তৈরির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও স্থানীয় লোকজন জানান, পাঁচ দশকের বেশি সময় আগে উপজেলার সমুদ্র উপকূলে বড় বড় চর জেগে ওঠার পর সেসব চরে গরু-মহিষের প্রাকৃতিক চারণভূমি তৈরি হয়। তখন সেসব উন্মুক্ত চারণভূমিতে হাজার হাজার মহিষ পালন শুরু করেন উপকূলীয় এলাকার মানুষ। সে সময় এসব মহিষ থেকে প্রচুর পরিমাণ দুধ পাওয়া গেলেও স্থানীয় চাহিদা ছিল কম। তখন বিক্রি না হওয়া বাড়তি দুধ দিয়ে দই তৈরি শুরু করেন অনেক মহিষমালিক ও দুধ সংগ্রহকারী।

মিরসরাইয়ে মহিষের দই তৈরির কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দই তৈরি করতে প্রথমে তাঁরা উপজেলা ও নোয়াখালীর সুবর্ণচরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মহিষের দুধ সংগ্রহ করেন। এরপর বাড়িতে এনে সে দুধ ছেঁকে বড় একটি পাত্রে রাখেন। সে দুধে আগের দিন তৈরি করা একটি পুরোনো দই গুলে মিশিয়ে দেন। এরপর দুধ স্থানীয় কুমোরবাড়ি থেকে সংগ্রহ করে আনা ছোট ছোট মাটির পাত্রে ঢেলে রাখা হয়। ঢেকে রাখার পর ৮-১০ ঘণ্টা অপেক্ষা করলেই হয়ে ওঠে সুস্বাদু দই।

মহিষের এই দইয়ের উৎপাদনপ্রক্রিয়াটি পুরোপুরি প্রাকৃতিক। এ দই তৈরিতে মহিষের দুধ ছাড়া আর কিছুই ব্যবহার করা হয় না। তা ছাড়া মিরসরাইয়ের উপকূলীয় এলাকা ও সুবর্ণচরের যেসব মহিষ আছে, সেগুলো কেবল চারণভূমির প্রাকৃতিক ঘাসের ওপর নির্ভরশীল। শতভাগ প্রাকৃতিক খাবার খায় বলে এসব মহিষের দুধের মান বেশ ভালো। তাই এ দুধে তৈরি দইয়ের হয় অতুলনীয় স্বাদ।

মিরসরাইয়ে মহিষের দই তৈরির সঙ্গে একসময় শতাধিক পরিবার যুক্ত ছিল। তবে এখন সেই সংখ্যা ১০-১২টি পরিবারে ঠেকেছে। শনিবার সকালে উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের পূর্ব ইছাখালী এলাকায় বাড়িতে গিয়ে কথা হয় মহিষের দই তৈরির এক কারিগর ইকবাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, মহিষের দই তৈরি করা তাঁর বাবা লাতু মিয়ার ৫০ বছরের ব্যবসা। বাবার হাত ধরে ২৫ বছর ধরে তিনিও মহিষের দই বানাচ্ছেন।

এক কেজির একটি দই বাজারে ২০০-২৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। প্রতি কেজি দুধ কিনতে হয় ১২০-১৩০ টাকায়। প্রতিদিন দুই মণের মতো দই বিক্রি হয় তাঁর। ফরমাশ পেয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরেও দই পাঠান তিনি। ইকবাল হোসেন আরও বলেন, এখন মিরসরাইয়ের উপকূলজুড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ায় মহিষের চারণভূমি কমে এসেছে। তাই চাহিদা বাড়লেও দুধসংকটে পর্যাপ্ত দই তৈরি করতে পারছেন না তাঁরা।

উপজেলার মিঠাছড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বাজার থেকে দুই হাঁড়ি দই কিনে বাড়িতে ফিরছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী মাহফুজুল হক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাড়িতে অতিথি এসেছে, তাঁদের আপ্যায়নের জন্য দই কিনেছি। হাজারো ভেজালের ভিড়ে মিরসরাইয়ের মহিষের দইটা এখনো খাঁটি আছে। মিরসরাইয়ে ছোট-বড় মেজবানি আর অতিথি আপ্যায়নে মহিষের এ দই এখনো অত্যাবশ্যকীয়।’

জানতে চাইলে মিরসরাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাকিরুল ফরিদ প্রথম আলোকে বলেন, মিরসরাইয়ের মহিষের দই পুষ্টিগুণে ভরা একটি ঐতিহ্যবাহী পণ্য। দই তৈরির এই স্থানীয় শিল্পটির সঙ্গে অনেক মহিষপালক ও দই তৈরির কারিগর যুক্ত রয়েছেন। শিল্পাঞ্চল হওয়ার কারণে উপকূলীয় এলাকায় মহিষের চারণভূমি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সরকার বিশেষ কোনো উদ্যোগ না নিলে মিরসরাইয়ে মহিষের দইয়ের এই শিল্প হয়তো আর বেশি দিন টিকবে না।

সূত্র: প্রথম আলো

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ