সোমবার   ০৮ জুলাই ২০২৪ || ২৩ আষাঢ় ১৪৩১

দৈনিক গাইবান্ধা

প্রকাশিত : ১০:১৪, ৫ জুলাই ২০২৪

পদ্মা সেতু: এক অসাধারণ যুদ্ধ জয়ের গল্প

পদ্মা সেতু: এক অসাধারণ যুদ্ধ জয়ের গল্প
সংগৃহীত

আজ আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু কার্যক্রমের সমাপ্তি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ পদ্মা সেতু কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করবেন। পদ্মা সেতু পরিচালনা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার আলাদা একটি কোম্পানি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি হবে। গতকাল মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘পদ্মা ব্রিজ অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেনেন্স কোম্পানি পিএলসি’ গঠনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু নিয়ে যে এক অহংকারের যুদ্ধ তার বিজয়গাঁথা শেষ হলো।

পদ্মা সেতুর নির্মাণ কেবল একটি সেতু নির্মাণ নয়। পদ্মা সেতুর নির্মাণ একটি আবেগ একটি অহংকার এবং একটি গৌরবের অধ্যায়। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার যেমন প্রতীক তেমনি এই সেতু বাংলাদেশের প্রতি অপমান এবং অবজ্ঞার বদলা নেয়ার এক স্মারক চিহ্নও বটে। বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর মাধ্যমে প্রমাণ করেছে এই দেশ মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। পদ্মা সেতু দিয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে আমরা মাথা নত করতে জানি না।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে ঐ বছরের ৬ জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইডিবি এবং এডিবি’র সঙ্গে পদ্মা সেতু ইস্যুতে ঋণ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির আওতায় পদ্মা সেতু নির্মাণের সমুদয় খরচ বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে এই কনসালটিয়ান  দাতারা বহন করার অঙ্গীকার করেছিলেন। 

কিন্তু কিছুদিন পরই মাত্র এক বছরের মধ্যে ২৯ জুন ২০১২ সালে কাল্পনিক, ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে এই ঋণ চুক্তি বাতিল করা হয়। ঋণ চুক্তি বাতিলের প্রেক্ষাপটটি ছিলো একটি ভয়ংকর দিক। এর মাধ্যমে শুধু পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে যায়নি, অপমান করা হয়েছিলো বাংলাদেশকে। অসত্য, ভিত্তিহীন দুর্নীতির গল্প সাজিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছিলো।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। তিনি অদম্য, সাহসী এবং দূরদর্শী একজন রাজনীতিবিদ। পদ্মা সেতুকে নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে এই অসত্য, ভিত্তিহীন অভিযোগ তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। ১০ দিনের মাথায় ৯ জুলাই ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। 

বিশ্বব্যাংক অবশ্য এরপর আবার ফিরে আসার চেষ্টা করেছিলো। তারা শর্ত সাপেক্ষে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছিলো। কিন্তু সেটি ছিলো এক ষড়যন্ত্রের অধ্যায়।  বিশ্ব ব্যাংক জানায়, পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করা হবে যদি সরকার দুর্নীতির তদন্ত করে।  এই শর্তে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দেশ পদ্মা সেতুর চুক্তি পুনঃনবায়নের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলো। 

কিন্তু বিশ্বব্যাংক এবং দাতাদের এর পেছনের উদ্দেশ্য ছিলো অত্যন্ত ভয়ংকর। তারা আসলে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে হেয় করতে চেয়েছিলো এবং পদ্মা সেতু নিয়ে একটি দুর্নীতির গল্প প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলো।  সরকার অবশ্য বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলো।  দুর্নীতি দমন কমিশনকে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে কিনা সেই ব্যাপারে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সেই সময়ের অন্যতম সদস্য ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন।

পদ্মা সেতু নিয়ে যখন বিশ্বব্যাংক জল ঘোলা করতে চাইছে, সেসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে দৃঢ় চিত্তে দাঁড়ান তৎকালীন দুদকের এই কমিশনার। মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেন এবং দুর্নীতির ব্যাপারে দুদকের অবস্থান সাহসীকতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করেন। 

তবে তার এই অবস্থান খুব সহজ সরল ছিলো না। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, তৎকালীন প্রধানন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীসহ আরো কয়েকজন বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা ও প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তদন্ত করা এবং কয়েকজনকে ফাঁসিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানসহ অন্যান্যরা। 

কিন্তু একাই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন অকুতোভয় মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। তিনি সেই সময় বলেছিলেন, "আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। আইন কোন পক্ষপাত বরদাস্ত করে না। দুর্নীতি যদি না হয় তাহলে আমি জোর করে দুর্নীতি দেখাতে পারবো না। " তার এই দৃঢ় অবস্থানের জন্যই শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতুর কেলেঙ্কারির নামে কিছু নিরীহ, নির্দোষ ব্যক্তিকে ফাঁসানো সম্ভব হয়নি।

পদ্মা সেতুর এই তদন্ত পর্যায়ে তৎকালীন সেতু সচিব মোশারফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। মন্ত্রীত্ব থেকে বাদ পড়েছিলেন প্রয়াত সেতুমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু পরিবারের কাউকে কাউকেও এর সঙ্গে জড়িয়ে দিতে সরকারের ভেতর থেকেও চেষ্টা ছিলো অনেকের।  কিন্তু মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের দৃঢ়তার জন্য শেষ পর্যন্ত সেই ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায়।  তার এই অদম্য সাহস এবং আদর্শবাদী অবস্থানের কারণেই শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু ষড়যন্ত্র আর সফল হয়নি।

পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী নিজ অর্থায়নেই নির্মাণ সম্পন্ন হয় পদ্মা সেতুর।   ২ বছর আগে ২৫ জুন পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। আমাদের গর্বের নিদর্শনটি দৃশ্যমান হয়।  পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশের মানুষের গৌরবের চিহ্ন।  এই সেতু কেবল অর্থনৈতিকভাবেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে না, বরং এই সেতু বাংলাদেশের স্বাবলম্বিতা, আত্মমর্যাদা এবং নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার জ্বলন্ত এক প্রমাণ।

নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার সাহসী সিদ্ধান্তটি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।  তার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অবস্থানের কারণেই পদ্মা সেতু আজ চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছে।  তবে প্রধানমন্ত্রীকে যারা এই সাহসিকতার জন্য সাহস জুগিয়েছেন, তাঁর পাশে থেকেছেন সহযোদ্ধার মতো, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন।  তিনি আজকে রাষ্ট্রপতি।  এটি যেন বাংলাদেশের এক অপূর্ব নিয়তি।  যাদের হাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে অহংকারের বস্তুটি নির্মিত হয়েছে তারাই এখন দেশ পরিচালনার প্রধান দুই দায়িত্বে।  পদ্মা সেতু যতদিন থাকবে, ততদিন বাংলাদেশ আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে।  সারা বিশ্বে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ পারে।

সূত্র: বাংলা ইনসাইডার

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ