রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ || ৭ পৌষ ১৪৩১

দৈনিক গাইবান্ধা

প্রকাশিত : ১৪:০৩, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জনসচেতনতা

মাঙ্কিপক্স: আতঙ্ক নয়, চাই সচেতনতা

মাঙ্কিপক্স: আতঙ্ক নয়, চাই সচেতনতা
সংগৃহীত

যেকোন রোগ তা সংক্রমক কি না তা জানা জরুরী এবং সেই ভাবে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে দেশে দেশে আর যাতায়াতের প্রতিবন্ধকতা নেই, সমগ্র বিশ্বে গণচলাচল বিদ্যমান। তাই এক দেশের ভাইরাস আরেক দেশে সহজেই প্রবেশ করে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যে সমস্ত দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি সে দেশে ভ্রমণ না করা উচিত। তবে ব্যক্তিগত সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতাই এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে সহায়ক। আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতা বেশি জরুরি

গত কয়েক বছর যাবত ডেঙ্গুর মহামারি চলছে। আবার কোভিড মহামারি শেষ না হতেই বিশ্বজুড়ে নতুন করে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে মাঙ্কিপক্স। ইতোমধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগ নিয়ে সতর্ক করেছে। এখন পর্যন্ত অনেক দেশে রোগটি ছড়িয়েছে। এ নিয়ে নানা গুজব আর ভ্রান্তিও ছড়িয়েছে। যেকোনো রোগ সম্পর্কে সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত ধারণা ও জ্ঞান আমাদের সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করে। তাই অকারণ আতঙ্কিত বা বিভ্রান্ত না হয়ে মাঙ্কিপক্স সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানুন ও সচেতন হোন।

মাঙ্কিপক্স নতুন নয় : মাঙ্কিপক্স কিন্তু নতুন কোনো রোগ নয়। ১৯৫৮ সালে প্রথম এ রোগ সম্পর্কে জানা যায়। তখন এটি বানরের মধ্যে দেখা যেত। ১৯৭০ সালে আফ্রিকা মহাদেশের কঙ্গোতে প্রথম মানুষের মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা যায়। তারপর থেকে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ যেমন কঙ্গো, ক্যামেরুন, নাইজিরিয়া, লাইবেরিয়া, গ্যাবন, সিয়েরা লিওন, কেনিয়া প্রভৃতি দেশে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণের কথা শোনা যায়।

তবে আফ্রিকার বাইরে ইউরোপের সুইডেন, এশিয়ার পাকিস্তান ও ফিলিপিন্সে কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছে। নাম শুনে অনেকেরই ধারণা হতে পারে এ রোগ বুঝি শুধু বানর থেকেই ছড়ায়, আসলে তা নয়। রোগটি প্রথমে বানরের মধ্যে দেখা দিয়েছিল বলে এর নাম মাঙ্কিপক্স। বানর, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, বন্য কুকুর ও খরগোশ থেকেও মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে এই ভাইরাস। এটি এক ধরনের জুনোটিক ডিজিজ, মানে প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ায়। তবে সাধারণত গৃহপালিত প্রাণী যেমন গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি থেকে এ রোগ ছড়ায় না।

মাঙ্কিপক্সের কারণÑ এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। ভাইরাসটি অর্থোপক্স গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এক কালের আতঙ্ক স্মলপক্স বা গুটি বসন্তের ভাইরাস ভ্যারিওলাও এই গোত্রের ভাইরাস। এই ভাইরাসটি দুই ধরনের ক্লেড ১ (মধ্য আফ্রিকান) এবং ক্লেড ২ (পশ্চিম আফ্রিকান)। এ ক্ষেত্রে, পশ্চিম আফ্রিকান ধরনের তুলনায় (৩.৬%) মধ্য আফ্রিকান ধরনের আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি (১০.৬%)।

ভাইরাসে রূপান্তর হয়ে ক্লেড ১বি নামে একটি নতুন ধরন তৈরি হয়েছে, যা সবচেয়ে ভয়ংকর। গত বছরের তুলনায় এই ভাইরাসের আক্রান্তের হার বেড়ে গেছে এবং মৃত্যুর হার বেড়েছে ১৯ শতাংশ। ফলে ভাইরাসটির উচ্চ মৃত্যুহার নিয়ে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে।

কিভাবে ছড়ায়Ñ সাধারণত মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত প্রাণী বা ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে এলে, শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে একে অপরকে সংক্রমিত করে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, থুতু কিংবা দীর্ঘক্ষণ মুখোমুখি আলাপচারিতার ফলেও মাঙ্কিপক্স ছড়াতে পারে এবং শরীরে থাকা ক্ষত বা ফোসকার সংস্পর্শে এলে এ রোগ সুস্থ দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন মেলামেশা এ রোগ ছড়ানোর অন্যতম কারণ। হোমোসেক্সচুয়াল বা সমকামীদের এই রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্যাদি যেমন-পোশাক, বিছানা, তোয়ালে ইত্যাদির সংস্পর্শে এলেও এটি বিস্তার লাভ করতে পারে।

উপসর্গ কী কীÑ এই রোগের উপসর্গ অনেকটা ফ্লুর মতো, ভাইরাসটি বায়ুবাহিত এবং প্রায় চার দিন বাতাসে টিকে থাকতে পারে। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার সাধারণত ৬ থেকে ১৩ দিনের মধ্যে, ক্ষেত্রবিশেষে ৫ থেকে ২১ দিনের মধ্যে প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পায়। এই ভাইরাসে যেকোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে। তবে ৯০% রোগী ১৫ বছরের কম বয়সী।

অনেকটা গুটি বসন্তের মতো হলেও মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ মৃদু। শুরুতে জ্বর, মাথাব্যথা, কাশি, হাঁচি, শরীরব্যথা, ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি দেখা দেয়। ফুলে যেতে পারে লসিকা গ্রন্থি। এক থেকে তিন দিনের মধ্যে সারা গায়ে বসন্তের মতো ফুসকুড়ি ওঠে। মুখে শুরু হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এই ফুসকুড়ি। বিশেষ করে হাতের তালু ও পায়ের তলায় বসন্তের মতোই প্রথমে লাল, তারপর ভেতরে জলপূর্ণ দানা, শেষে শুকিয়ে পড়ে যেতে থাকে।

মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যৌনাঙ্গ এবং পায়ুপথের আশপাশে ফুসকুড়ি সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়। এই ফুসকুড়িগুলো পরে ফোসকায় পরিণত হয়, পরে তা শুকিয়ে খোশপাচরার মতো হয় এবং প্রচ- পরিমাণে চুলকানি ও ব্যথা হয়। দুই থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হয় এই রোগ। তারপর নিজে নিজেই সেরে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তেমন বড় কোনো জটিলতা হয় না। যদিও এ রোগের উপসর্গগুলো সাধারণত মৃদু আকারে প্রকাশ পায়, তবে ক্ষেত্রবিশেষে শিশু, গর্ভবতী বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য এ রোগটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

জটিলতা : কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাঙ্কিপক্সের কারণে শরীরে কিছু জটিলতা দেখা যায়। যেমন স্থায়ী ক্ষত, বিকৃত দাগ, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে যেমন ফুসফুস, ব্রেইন ও চোখে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়তে পারে। চোখের কর্নিয়ায় ইনফেকশন ছড়িয়ে গেলে রোগী দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলতে পারে।

কিভাবে শনাক্ত করা যায় : মাঙ্কিপক্স শনাক্তের ক্ষেত্রে পিসিআর পরীক্ষাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। এক্ষেত্রে ত্বকের ক্ষত স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া বায়োপসির মাধ্যমেও এ রোগটি নির্ণয় করা সম্ভব। 

চিকিৎসা কী : মাঙ্কিপক্স একটি ভাইরাসজনিত রোগ বলে আপনা থেকেই সেরে যায়, তেমন কোনো চিকিৎসার দরকার পড়ে না।

উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা যেমন জ্বর বা শরীর ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, প্রচুর পুষ্টিকর খাবার ও পানি গ্রহণ, বিশ্রাম ইত্যাদিই হলো চিকিৎসা। এখন পর্যন্ত এ রোগের জন্য অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসার কোনো নির্দেশনা নেই। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোনো ওষুধ গ্রহণের দরকার নেই। আক্রান্ত রোগীকে প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এবং ক্ষত না শুকানো পর্যন্ত আলাদা রাখতে হবে।

মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে কী করবেন : যেকোনো ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। তাই মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে আমাদের যা করতে হবে :

(১) মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ রয়েছে যেমন জ্বর, কাশি, শরীর ব্যথা বা ফুসকুড়ি আছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা এবং শারীরিক সংস্পর্শ পরিহার করা। ত্বকের ফোসকা সম্পূর্ণরূপে ভালো না হওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই রোগীকে ক্ষত না শুকানো পর্যন্ত আলাদা রাখতে হবে। 
(২) যেহেতু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে, তাই আক্রান্ত ব্যক্তি এবং সেবা প্রদানকারী উভয়ে মাস্ক ব্যবহার করা।
(৩) নিয়মিত সাবান অথবা অ্যালকোহল সম্পন্ন হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা।
(৪) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে, যেমন হাঁচি কাশির সময় টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করা, যেখানে সেখানে থুতু না ফেলা ইত্যাদি।
(৫) আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিস সাবান, জীবাণুনাশক ডিটারজেন্ট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা।
(৬) আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্যাদি যেমন তোয়ালে, রুমাল, বালিশ, চাদর ইত্যাদির সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকা।
(৭) পরিবারে কেউ আক্রান্ত হলে, তাকে আলাদা রুমে রাখা এবং পরিবারের সবার মাস্ক ব্যবহার করা।
(৮) আক্রান্ত বন্যপ্রাণী অথবা ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা। প্রাণীর কামড়, আচর, লালা বা প্র¯্রাবের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা এবং অসুস্থ, মৃত কোনো প্রাণীর সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকা।
(৯) অসুস্থ অবস্থায় এবং সংক্রমিত কোনো দেশে ভ্রমণ না করা উচিত।
(১০) সংক্রমিত কোনো দেশে ২১ দিনের মধ্যে ভ্রমণ করলে তাকে চিকিৎসা নিতে হবে।
(১১) আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার পর ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে কনডম ব্যবহার করতে হবে।
(১২) আক্রান্ত দেশ থেকে আসা যাত্রীদের যে কারও জ্বর, কাশি, হাঁচি বা গায়ে ফুসকুড়ির মতো দেখা দিলে তা অবশ্য অবশ্যই পরীক্ষা করতে হবে।

টিকা : ব্যাপক টিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে গুটিবসন্ত বা স্মলপক্স বহু আগেই বিশ্ব থেকে নির্মূল হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, গুটিবসন্তের টিকা মাঙ্কিপক্সের বিপরীতে ৮০-৮৫ শতাংশ কার্যকর। কিন্তু গুটিবসন্ত নির্মূল হয়েছে বলে বর্তমানে এই টিকা আর কাউকে দেওয়া হয় না। মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে টিকা রয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত গণহারে টিকা ব্যবহারের কোনো নির্দেশনা নেই।

তবে টিকা তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা সংক্রমণের ঝুঁকিতে বা রোগীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে রয়েছে। অনুমোদিত না হলেও জরুরি ব্যবহারের জন্য মাঙ্কিপক্সের টিকা দেওয়ার জন্য ওষুধ প্রস্তুতকারকদের নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
দরকার সচেতনতা : মৃদু হলেও যেকোনো সংক্রামক রোগ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা প্রয়োজন। বর্তমানে দেশে দেশে আর যাতায়াতের প্রতিবন্ধকতা নেই, সমগ্র বিশ্বে গণচলাচল বিদ্যমান।

তাই এক দেশের ভাইরাস আরেক দেশে সহজেই প্রবেশ করে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যে সমস্ত দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি সেদেশে ভ্রমণ না করা উচিত। তবে ব্যক্তিগত সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতাই এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে সহায়ক। আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতা বেশি জরুরি।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ