রবি ফসলেই স্বাবলম্বী হচ্ছে সুন্দরগঞ্জের তিস্তার চরাঞ্চলবাসি
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চলে এবছর ব্যাপক রবি ফসলের চাষাবাদ করা হয়েছে। দেখলে মনে হয় সবুজের সমারোহ ঘটেছে। বাম্পার ফলনেরও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চরাঞ্চলের উৎপাদিত ফসল দেশের চাহিদা পূরণে ব্যাপকভাবে অবদান রাখছে। চরের অধিকাংশ কৃষকই নিজেদের জমিতে উৎপাদিত ফসলের ওপর নির্ভরশীল। নদী ভাঙন, বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই চরের মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়।
তাই বর্ষাকাল চলে গেলেই যখন যে ফসলের প্রয়োজন, সেই ফসল চাষ করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রি করে কৃষকরা জীবনযাত্রার উন্নতি ঘটাচ্ছে। হচ্ছেন স্বাবলম্বী। তিস্তার বুকে ভিটেমাটি হারানো হাজার হাজার মানুষ এখন ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন। চরাঞ্চলের জমি অসমতল হওয়ায় ইরি-বোরোর পরিবর্তে রবি’র সব ধরনের ফসল চাষ করা হচ্ছে। সারা বছরই কোন না কোন ফসল ও সবজির আবাদ করা হচ্ছে। এরফলে চরগুলোতে দেখা দিয়েছে কর্মচাঞ্চল্য। তিস্তার গো-চারণভূমি এখন বিভিন্ন প্রকার ফসলে ভরে গেছে। খরস্রোতা নদীর চর এখন সবুজ প্রান্তর। মাঠজুড়ে সব ধরনের ফসলে যেন ঘটেছে সবুজের সমারোহ। প্রতিটি বাড়ির উঠানে চাষ করা হয়েছে সবজি। প্রতিটি বাড়ি যেন সবজির খামার। যার কারণে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরতে শুরু করেছে তিস্তা নদীর চরাঞ্চলের প্রতিটি ঘরে। বর্তমান মৌসুমে বেড়েছে চাষাবাদ। প্রতি বছর বন্যায় চরের জমিতে পলিমাটি জমে। এজন্য উর্বরতা শক্তি অনেক বেশি। ভুট্টা, বাদাম, আলু, মাসকালাই, মরিচ, মুলা, শিম, লাউ, জিরা, তিল, তিসি, পেয়াজ, রসুন, গম, কাউন ইত্যাদি ফসলের ব্যাপক চাষাবাদ করা হয়েছে। দিগন্ত জুড়ে শুধু সবুজের সমারোহ। পুরুষের সাথে নারীরাও কৃষি কাজ করছে। বর্ষার সময় তাদের তেমন কাজ থাকে না। তাই রবি মৌসুমে কাজ করেই সারা বছর জীবনযাপনের অর্থের যোগান দেন চরাঞ্চলের মানুষ।
এ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টি ইউনিয়ন নদী বিধ্বস্ত। ইউনিয়নগুলো হচ্ছে, তারাপুর, বেলকা, দহবন্দ, হরিপুর, চন্ডিপুর, শ্রীপুর, কঞ্চিবাড়ী ও কাপাসিয়া। এই ৮টি ইউনিয়নে প্রায় ছোট ছোট ২০ াট চর রয়েছে। ধূ-ধূ বালুচরে কৃষকরা বিভিন্ন প্রকার রবি ফসলের চাষাবাদ করেছেন। দেখলে মনে হয় চরে যেন সবুজের সমারোহ ঘটেছে। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় আবাদের লক্ষণ মোটামুটি ভাল। বুকভরা আশা নিয়ে মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ফসল ফলাতে ব্যস্ত কৃষকরা। উদ্দেশ্য একটাই খেয়ে-পরে একটু ভালো থাকা। মূল লক্ষ্য সংসারের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত্ব ফসল বিক্রির অর্থ দিয়ে বর্ষা মৌসুম পার করা। রবি ফসলকে ঘিরে নদী গর্ভে নিঃস্ব হওয়া হাজার হাজার কৃষকের মুখে এখন সুখের হাসির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। কৃষি বিভাগ থেকে কম খরচে অধিক ফলন ফলানো, বীজ সংরক্ষণসহ কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চলতি মৌসুমে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে এক হাজার ১৫৪ হেক্টর। সরিষা ২ হাজার ৭৯৭ হেক্টর, আলু এক হাজার ৫০, ভুট্টা ৩ হাজার ৮২০, মিষ্টি আলু ৫০, মরিচ ১৫০, মুগডাল ১০, মসুর ডাল ৬০, খেসারী ডাল ৫০, বাকলা ডাল ৭, চিনা বাদাম ১৫০, সূর্যমুখী ১২, রসুন ৭৬, তিল ৯, কালোজিরা ৭, তিসি ৫, ধনিয়া ২২, চিনা ১৬, কাউন ৭, আখ ৮, তরমুজ ৮, পেয়াজ ৪৬৫ ও শাক-সবজি ৭৭৩ হেক্টর অর্জিত হয়েছে। চরাঞ্চলেই রবির চাষ হয়েছে বেশি। এক সময় তিস্তা নদীর করাল গ্রাসে হাজার হাজার পরিবার আবাদী জমি, বসতবাড়ী হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলো। কিন্তু তিস্তা নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় প্রায় ২৫ বছর আগে জেগে উঠেছে ছোট ছোট বালু চর। এই চরে রবি ফসল চাষ করা যায় নির্ভয়ে। তাই রবি মৌসুমে কৃষকরা ব্যাপক চাষাবাদে মাঠে নেমেছেন কোমড় বেঁধে। ধু-ধু বালু চরে যেখানে যে ফসল প্রযোজ্য তাই চাষাবাদ করেছেন কৃষকরা।
এছাড়া গত বর্ষা মৌসুমে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৬ হাজার ৭৬০ জন কৃষককে পুণর্বাসনের জন্য প্রত্যেককে এক বিঘা করে জমি চাষের জন্য কৃষি প্রণোদনার সার ও বীজ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে সরিষা ৩ হাজার ৮০০ জন কৃষককে, গম এক হাজার ৪৫০ জন, ভুট্টা এক হাজার ১০০ জন, সূর্যমূখী ৭০, চিনা বাদাম ১৪০, পেয়াজ ৮০, মুগডাল ৩০, সয়াবিন ৪০ ও মসুর ডাল ৫০ জন কৃষককে বীজ ও সার দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ভুট্টা ও সরিষার প্রদর্শনী দেয়া হয়েছে ৬০ জন কৃষককে। বন্যায় আমন ক্ষেত নষ্ট হওয়ায় পতিত জমিগুলোতে আগাম করে রবি ফসল চাষ করেছেন কৃষকরা। তাদের আসা আমনের লোকসান যেন রবিতে উঠে আসে। বিশেষ করে কৃষকরা আগ্রহ দেখাচ্ছে আলু, মরিচ, বাদাম, রসুন, পেয়াজ ও ভুট্টা চাষের উপর। কারণ এফসলগুলোতে অধিক লাভ হয় এবং বন্যার আগে ফসল ঘরে তোলা যায়।
তারাপুর ইউনিয়নের চরখোর্দ্দা গ্রামের মোজাম্মেল হক ও হরিপুর ইউনিয়নের চর কানি চরিতাবাড়ি গ্রামের হাসান আলী বলেন, রবি ফসলই আমাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস। তাই রবি চাষে মাঠে কোমর বেধে নেমেছি। কারণ আমন ফসল ঘরে তোলা নির্ভর করে বন্যার উপর। বেলকা ইউনিয়নের জিগাবাড়ী চরের কৃষক আহসান, তারাপুরের জাহেদুল বলেন, আমরা কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলাই। কিন্তু আমাদের বিক্রি করা ফসলের বেশি লাভ চলে যায় ফরিয়াদের পেটে। কারণ চরের রাস্তাঘাটের কোন উন্নতি হচ্ছেনা। চরের যানবাহন এখন ঘোড়ার গাড়ি। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বাধ্য হয়ে কম লাভে ফসল বিক্রি করছি। চরবাসির দাবি কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক যন্ত্রপাতি, যেমন কম্বাইন্ড হারভেস্টার, ট্রাক্টর, রোটাভেটর ইত্যাদি যোগান দিতে হবে। সেই সাথে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে। দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানো যাবে। জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে। সবার আগে যোগাযোগ ব্যবস্তার উন্নতি ঘটাতে হবে।