গাইবান্ধায় দুইশ বছরের ঠাকুরবাড়ী মেলা, ঐতিহ্য আর গ্রামীণপণ্যের বর্ণিল পসরা
গ্রামীণ জনপদে লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো মেলা। পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেও মেলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মেলাকে কেন্দ্র করে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ আসে মেলায়। সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই পারস্পরিক যোগাযোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া মেলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব তো রয়েছেই।
দুইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী গাইবান্ধার ঠাকুরবাড়ি বৈশাখী মেলা। সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের ঠাকুরবাড়ি মন্দিরে শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে গৌড়-নিতাইয়ের পূজা দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছরই বৈশাখ মাসের প্রথম রবিবার এ- মেলার আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। অন্যসব আয়োজন থেকে এ বৈশাখীমেলা একটু পৃথক। উত্তরাঞ্চলের প্রধান এ গ্রামীণ মেলার বর্ণিল রূপ এবং ঐতিহ্য আলাদা সত্ত্বা ও অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে গাইবান্ধাবাসীর কাছে।
স্থানীয় কারুশিল্পীদের উৎপাদিত পণ্য এবং কৃষিপণ্যই ঠাকুরবাড়ি বৈশাখী মেলার মূল বেচাকেনার জিনিস। বাঁশ, বেত, পাট, শোলা, ধাতব, মৃৎ, চামড়া, তন্তুজাত হরেক রকমের কারুপণ্য ও বাচ্চাদের খেলনার বিপুল সমাবেশ গ্রামীণ এ মেলাকে বর্ণাঢ্য করে তোলে। এর পাশাপাশি থাকে খাজা, গজা, মওয়া, সাজ-বাতশা, মুড়ি-মুড়কি, জিলাপী এসব খাদ্যসামগ্রীর সমাবেশ। থাকে নাগরদোলা, লাঠিখেলাসহ হরেক রকমের আয়োজন।
জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মানুষ এখান থেকে এক বছরের গৃহস্থালি টুকিটাকি সংগ্রহ করেন। এখানে গৌর-নিতাইয়ের বিগ্রহ রয়েছে। সারাবছর বিগ্রহের পূজাঅর্চনা হয়। তবে বৈশাখ মাসজুড়ে পূজার্চনার সাথে প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার ঠাকুরবাড়িতে বা ঠাকুরবাড়ির অঙ্গনে এ মেলা বসে। আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এমনকি বিদেশ থেকেও পুণ্যার্থীরা বৈশাখ মাসে ঠাকুরবাড়িতে আসতেন। তবে মেলার আর আগের জৌলুস নেই।
রোববার (২৮ এপ্রিল) সরেজমিনে মেলা ঘুরে দেখা যায়, ঠাকুরবাড়ি মন্দির চত্বরে বুড়ো বটগাছ ঘিরে রাজ্যের ব্যস্ততা। একপাশে নাগরদোলা। গ্রামীণ সড়কের দুপাশে জিনিসের স্তূপ। কেউ গাঁইট খুলে পণ্যের পসরা সাজাচ্ছেন, কেউ ছাউনির ব্যবস্থা করতে টানাচ্ছেন শামিয়ানা। এর মধ্যে আধখোলা গাঁইট থেকেই জিনিসপত্র দেখছেন ক্রেতারা। চলছে দরদাম। কেনাকাটা শুরু হলো বলে। বেলা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে মানুষের আনাগোনা। বাড়ছে হাঁকডাক। সব বয়সীর ভিড়ে মুখর হয়ে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ। বছরজুড়ে অপেক্ষা যেন এই ব্যস্ততার!
মাটির তৈরি তৈজসপত্র, মাটির টেপা পুতুল, কাচের চুড়ি, পাট পণ্যের পাশাপাশি কাঠের পুতুল, হাতপাখা, মুড়ি-মুড়কি, বাঁশি, শিশুদের খেলনা, টমটম গাড়ি, ইমিটেশনের গহনা, শীতলপাটি, গাছের চারা, মাছ ধরার চাঁই, ডালা, কুলা, দা-বঁটি, প্লাস্টিকের ফুলসহ বাহারি সব জিনিস কিনে নিচ্ছেন মানুষজন। বেশি ভিড় দেখা যায় মাটির তৈরি সৌখিন জিনিসপত্রের দোকানে।
ব্রিটিশ শাসনামলে ঠাকুরবাড়ি মন্দির নির্মাণের পর ১৮২০ সালের দিকে এ মেলার আয়োজন করেন জমিদার নরেন্দ্র লাহিড়ী। দুইশ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে এই মেলা। তবে কালের প্রবাহে মানুষের রুচি-পছন্দ অনেক বদলেছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে শহরের সঙ্গে গ্রামের ব্যবধানও অনেকটা ঘুচেছে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার বিস্তার ঘটেছে প্রত্যন্ত জনপদেও। ফলে রূপান্তর এসেছে মেলার আঙ্গিকেও। মেলা থেকে ক্রমশ নির্বাসিত হচ্ছে বাঁশ-বেতের সামগ্রী, সূচিশিল্প, কাঁসা-পিতল শিল্প, মৃৎশিল্পের নিদর্শন কারুপণ্য সামগ্রী। সংকুচিত হচ্ছে মেলার পরিসর। যোগ হচ্ছে প্লাস্টিকের পণ্য। ঐতিহ্যবাহি এই মেলাকে বাঁচিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় আরো বড় পরিসরে আয়োজনের দাবি এলাকাবাসীর।