হাওয়াই মিঠাই: শৈশবের এক টুকরো আনন্দ
হালকা গোলাপি রঙের মাকড়সার জাল। স্বাদে মিষ্টি। মুখে মিষ্টি স্বাদের আঁচড় দিয়ে মুহূর্তেই নিঃশেষ। হাওয়ার সঙ্গে এই মিঠাই নিমিষে বিলীন হয়ে যায় বলেই এর নাম ‘হাওয়াই মিঠাই’। অথচ এই খাবারটির মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় শৈশবের এক টুকরো আনন্দ।
‘হাওয়াই মিঠাই নেবে... হাওয়াই মিঠাই....মিষ্টি নরম গোলাপি-সাদা হাওয়াই মিঠাই...!’— মাঝ বয়সী বা বৃদ্ধ ফেরিওয়ালারা টিন-কাচের বাক্সে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে এভাবেই হাজির হতেন। ক্লান্ত দুপুরে এ যেন এক টুকরো স্বপ্নের মতো বিষয় ছিল।
ফেরিওয়ালার ডাক শুনেই কচি-কাঁচারা হাজির হতো পুরোনো প্লাস্টিক বা কাচের বোতল নিয়ে। অনেকের হাতে থাকতো লোহার টুকরো। এসব পুরোনো জিনিসের বদলে দু-চারটা মিঠাই পাওয়া অনেক আনন্দের ছিল। ভাঙারি জিনিস খুঁজে না পেলে অনেকেই বড়দের কাছে বায়না ধরতো। ২৫ পয়সা থেকে ১ টাকা খরচ করলেই মিলতো কয়েক পিছ।
গ্রামের আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ তো পটেই বিভিন্ন মেলাতেও ‘হাওয়াই মিঠাই’ পাওয়া যেত।বিশেষ করে ধান কাটার মৌসুমে দেখা পাওয়া যায় হাওয়াই মিঠাই ফেরিওয়ালাদের। পিতল বা কাসার ঘণ্টার টিং টিং শব্দ তুলে শিশু-কিশোরদের দৃষ্টি কাড়ে তারা। নানা ধরনের স্লোকও বলতেন তারা। আর তাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়তো কচিকাঁচার দল।
যে খাবারের নামই হাওয়াই মিঠাই, তা খেয়ে পেট না ভরাটাই তো স্বাভাবিক! এটি মুখের স্বাদ মেটায় শুধু। দেখতে ক্রিকেট বলের মতো মনে হলেও নিমিষেই এটি মুখের ভেতর এসে গলে যায়। বিশেষ করে গ্রামের শিশুরা এই মিঠায়ে বেশি আনন্দ পায়। বড়রাও এর স্বাদ থেকে পিছিয়ে থাকেন না। দাম কম ও দেখতে সুন্দর হওয়ায় সবার আগ্রহ থাকে এই মিঠাইয়ের প্রতি।
এখন এমন বেশে ফেরিওয়ালাদের দেখাই যায় না। ছবি তুলেছেন মো. সাব্বির
‘ভেজালমুক্ত খাবার’
এখনও হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করেন লালমনিরহাট সদরের তিনদীঘি গ্রামের কানু রায়। ৫৭ বছর বয়সী এ ফেরিওয়ালা ৩৭ বছর ধরে ‘হাওয়াই মিঠাই’ বিক্রি করছেন। আগে সারা বছরই এ ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। বর্তমানে বছরে তিন-চার মাস তিনি এ ব্যবসা করেন। বিশেষ করে ধান কাটার মৌসুমে। মাঝে-মধ্যে গ্রামে মেলা বসলে এই ব্যবসা করেন।
কানু রায় বলেন, হাওয়াই মিঠাই একটি বিশুদ্ধ সামগ্রী, ভেজালমুক্ত হওয়ায় এটি খেতে শিশুদের কোনো ঝুঁকি নেই। শিশুরা আনন্দ সহকারে এটি খেতে পছন্দ করে আর আমরাও আনন্দের সঙ্গে তা বিক্রি করি। শুধু শিশুরাই নয় বড়রাও আমার কাছ থেকে হাওয়াই মিঠাই কিনে খায়।
৬২ বছরের কান্দ্রি বালা বর্মণ জানান, তিনি আজও ভুলতে পারেন না ‘হাওয়াই মিঠাই’র স্বাদ। এখনো গ্রামে গ্রামে হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতা আসলে তিনি তা কিনে শিশুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজা করে খান।
কালের সঙ্গে বদলে যাওয়া
কাচে ঘেরা টিনের বাক্সের ছোট ছোট হাওয়াই মিঠাই হারিয়ে গেছে। তবে এখনও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি এ মিঠাই। কালের পরিক্রমায় আজ সেই ছোট ছোট গোলাকার হাওয়াই মিঠাই আকারে ফুলে ফেঁপে বেশ বড় হয়েছে। এখন কাঠিতে পেঁচিয়ে পলিথিনে মোড়ানো বিভিন্ন রঙের হাওয়াই মিঠাই দেখা যায় শহরের পথে পথে। দামও বেড়েছে; দশ থেকে পনেরো টাকায় এখনও এ স্বাদ মুখে নেয়া যায়।
হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার চাইতেও এর দেখার আকর্ষণটা কোনো অংশে কম নয়। পেজা তুলোর মতো তুলতুলে ও গোলাপি-সাদা রঙের এই ঐতিহ্যবাহী হাওয়াই মিঠাই দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কালের পরিক্রমায় আজ সেই ছোট ছোট গোলাকার হাওয়াই মিঠাই আকারে ফুলে ফেঁপে বেশ বড় হয়েছে। কাঠিতে পেঁচিয়ে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় এখন সব জায়গায় পাওয়া যায়।
ইতিহাস কী বলছে?
বলা হয়ে থাকে হাওয়াই মিঠাইয়ের আদি ঘর ইতালিতে। তখন চিনির ঘন রসকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সুতার মতো করে এটি বানানো হতো। তখনও খুব বেশি পরিচিতি পায়নি এ খাবার। আঠারো শতক পর্যন্ত ঘরোয়াভাবে তৈরি হতো খাবারটি।
ইতিহাস বলছে, ১৮৯৭ সালে মার্কিন উইলিয়াম মরিসন ও জন সি. ওয়ারটন প্রথমবার হাওয়াই মিঠাই তৈরির যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। আধুনিক পদ্ধতিতে এ খাবার তৈরি শুরু হওয়ার পরও খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে যখনই এ খাবার ১৯০৪ সালে সেন্ট লুইস বিশ্ব মেলায় গেল, তখনই জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে হুড়মুড় করে।
বিশ্ব মেলার পরই মূলত খাবারটি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পায় খাবারটি। চাহিদা ও জনপ্রিয়তার জন্য একাধিক কোম্পানি এগিয়ে এল এই মজাদার খাবার তৈরিতে। দামি চকলেট, আইসক্রিম কিংবা ক্যান্ডিতে সয়লাব বাজারেও হাওয়াই মিঠাইয়ের কদর বাড়তে থাকে। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে এ খাবার।
ইংরেজিতে রয়েছে এর কিছু মজাদার নাম; যেমন কটন ক্যান্ডি, ফেয়ারি ফ্লস, ক্যান্ডি ফ্লস কিংবা স্পুন সুগার। দেখতে অনেকটা তুলার মতো বলে ১৯২০ সালে মার্কিনরা এই মিঠাইয়ের নাম দিয়েছে ‘কটন ক্যান্ডি।’ তারা এই হাওয়াই মিঠাইয়ের এতই ভক্ত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭ ডিসেম্বর দিনটি ‘জাতীয় কটন ক্যান্ডি ডে’ হিসাবে পালন করা হয়।
সূত্র: ডেইলি-বাংলাদেশ